"A physicist is just an atom's way of looking at itself"― Niels Bohr (1885―1962)
শুভ জন্মদিন নীলস বোর
পূ র্ণ চ ন্দ্র ভূ ঞ্যা
(এক)
"ব্যারোমিটার প্রয়োগ করে একটি গগনচুম্বী অট্টালিকার উচ্চতা কীভাবে নির্ণয় করবে আলোচনা কর"― কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স ডিগ্রি পরীক্ষার প্রশ্ন এটি। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এ হেন প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলেন পরীক্ষক অধ্যাপক। সালটা ছিল ১৯০৩।
গোটা ক্লাস নিরুত্তর। উত্তর জানা নেই কারও। কারণ সে-সময় ঐ প্রশ্নের কেবল একটি মাত্র সমাধান আছে এবং ক্লাসে উপস্থিত কোনও ছাত্র এর সদুত্তর দিতে পারবে না― এমনই বদ্ধমূল ধারণা ছিল প্রশ্নকর্তা ইনভিজিলেটার অধ্যাপকের। এদিকে ভিড়ের মধ্যে থেকে হাত উপরে তুলেছে এক পড়ুয়া! অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
"একটি সরু লম্বা তার দিয়ে ব্যারোমিটারের গলাটা শক্ত করে বাঁধলাম। তারপর ধীরে ধীরে ব্যারোমিটারের নীচ প্রান্তটি গগনচুম্বী অট্টালিকার ছাদ থেকে মাটিতে স্পর্শ করালাম। এখন তারের দৈর্ঘ্য ও ব্যারোমিটার দৈর্ঘ্যের যোগফলই হবে বিল্ডিংয়ের উচ্চতা"― পরীক্ষকের বিষ্ময়ের ঘোর কাটার আগেই উত্তর দেয় ছাত্রটি।
এ হেন প্রত্যুত্তরে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন পরীক্ষক। চেনা ছকের বাইরে আরও যে সমাধান থাকতে পারে এর, তা ছিল তাঁর কল্পনাতীত। এর থেকেও বড় কথা তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে ছেলেটি। ছেলেটির ঔদ্ধত্যে তিনি এতটাই ক্ষিপ্ত হলেন যে তৎক্ষণাৎ ছাত্রটিকে ফেল করালেন পরীক্ষায়। এদিকে ছাত্রটিও অনড়। তার দেওয়া উত্তর সঠিক বলে গোঁ ধরে বসে আছে সেও। তার উত্তর নির্ভুল― এই গ্রাউন্ডে ইউনিভার্সিটির কাছে আবেদন জানায় সে। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় স্বাধীন বিচারক নিযুক্ত করে উক্ত ঘটনার সঠিক নিরপেক্ষ তদন্ত করতে।
এ হেন সালিশি সভার শেষে রিপোর্টে বিচারক বলেন― "সম্ভবত উত্তরটি সঠিক, তবে ফিজিক্সের বর্তমান সিলেবাসে এর উল্লেখযোগ্য সমাধান এখনও অধরা।" ব্যাস, ছাত্রের জেদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ। ভুল শুধরে অফিসে ডেকে পাঠানো হয় তাকে।
এবার নিরপেক্ষ বিচারকের সম্মুখে পুনরায় বসানো হল ছেলেটিকে। পূর্বের প্রশ্নের মৌখিক উত্তর দিতে বলা হয় তাকে। সময় মাত্র ছ'মিনিট। ফিজিক্সের মৌলিক তত্ত্বের সাহায্যে ন্যূনতম যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে তার দেওয়া উত্তর সঠিক।
কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। সেদিকে যেন ভ্রুক্ষেপ নেই পরীক্ষার্থীর। কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে আছে সে। যেন গভীরচিন্তায় মগ্ন। উফ! কী আস্পর্ধা! ইতিমধ্যে পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত। সাধারণ মানের পরীক্ষার্থী হলে টেনশনে এতক্ষণে ঘেমে-নেয়ে একশা হয়ে যেত। কিন্তু কঠিন তার অধ্যবসায় ও জেদ। পরীক্ষক আরও একবার মনে করিয়ে দেয় তার হাতে আর এক মিনিট সময় অবশিষ্ট আছে।
"সমস্যাটির বেশ কয়েকটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক উত্তর জানি। কোন উত্তরটি বলব মনস্থির করতে পারছি না"― সবাইকে চমকে দিয়ে মুখ তুলে ঘোষণা করে সে। তারপর কর্তৃপক্ষের উপদেশ মেনে প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করে তার বক্তব্য। সন্তুষ্ট হন পরীক্ষক। এবার আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয় সে। এ হেন ছাত্রটিই পরবর্তী কালে পরমাণু মডেলের সফল রূপকার নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী।
(দুই)
"এটেনশন প্লিজ, স্যার। অল্প ক্ষণের ব্যবধানে নরওয়ের আকাশ সীমায় ঢুকব আমরা। নীচে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিশাইল আকাশে টার্গেট করে বসে আছে শত্রু। যে কোন সময় আঘাত হানতে পারে। শত্রুপক্ষের নিশানা এড়াতে অত্যাধিক উচ্চতায় প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে বিমান ওড়ানো একান্ত জরুরি। হাই-অল্টিচিউডে অক্সিজেন ঘাটতি বেশি। প্লিজ, আপনি কৃত্রিম অক্সিজেন মাস্ক পরে নিন।" এ হেন অস্ত্রহীন উচ্চগতির ব্রিটিশ বোম্বার এয়ারক্র্যাফ্ট-এ সওয়ারী এক গুরুত্বপূর্ণ অতিথি অধ্যাপক। তাঁকে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি ফরোয়ার্ড করছেন বিমানের পাইলট। ইন্টারকম ব্যবস্থার মাধ্যমে। এ হেন অতিথিকে নাৎসি জার্মান অধ্যুষিত নরওয়ের আকাশ সীমা দিয়ে নিরাপদে ব্রিটেনে পৌঁছে দেওয়ার গুরু দায়িত্ব পড়েছে বিমান পাইলটের ওপর।
এদিকে ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে বিমানের ভেতর কার্পেটে শুয়ে আছেন অতিথি। সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায়। কারণ হাই-অল্টিচিউডের অক্সিজেন সংকট। ফ্লাইং হেলমেট ছোট পড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন মাস্কও চালু করতে পারেননি তিনি। তাই এমন অবস্থা তাঁর। শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে এভাবে তিন ঘন্টা রূদ্ধশ্বাস জীবনমৃত অবস্থায় বিমানে অজ্ঞান থাকেন তিনি। তিন ঘন্টা পর স্কটল্যান্ড পৌঁছয় বিমান। সেদিন ৬-ই অক্টোবর ১৯৪৩। সুস্থ হলে পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক এবং স্যার জন অ্যান্ডারসন উষ্ণ অভিনন্দন সহযোগে ব্রিটেনে স্বাগত জানান আগন্তুক অতিথিকে।
অবশ্য তার আগের এক মাসেরও বেশি কাল চরম উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তায় কেটেছে তাঁর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালবৈশাখী ঝড়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে যেন। সে-বছর সেপ্টেম্বরে খবর রটে যায় যে মায়ের দিক থেকে জন্মসূত্রে সে ও তাঁর ভাই ইহুদি বংশোদ্ভূত। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করতে মরিয়া। ওৎ পেতে আছে সর্বক্ষণ। এ হেন সংবাদে ভীত সে গোপনে সস্ত্রীক ডেনমার্ক ছাড়ে। দুজনে সমুদ্র পথে পাড়ি দেয় সুইডেন। অবশ্য এই গৃহত্যাগের পশ্চাতে অনেক গূঢ় কারণ বর্তমান। ১৯৪০ সালে ইতিমধ্যে আক্রমণ করে ডেনমার্ক-এর দখল নেয় জার্মানি। শয়ে শয়ে ইহুদি বংশোদ্ভূত মানুষজন স্বজন ছেড়ে, নিজ ভূমি ছেড়ে পাড়ি জমায় তুলনামূলক নিরাপদ আশ্রয়ে। এ হেন বিশিষ্টজনের সাহায্যার্থে একটি ফান্ড গড়েন তিনি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দেশের সরকার বাহাদুরের সঙ্গে আলোচনা করে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশের সম্মতি আদায় করা, নতুন জায়গায় উপযুক্ত সম্মান ও কাজের বন্দোবস্ত করা সহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। এর মাঝে ১৯৪১-এর সেপ্টেম্বরে কোপেনহেগেনে নোবেল বিজয়ী হাইজেনবার্গের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ করেন। হাইজেনবার্গ তখন জার্মান নিউক্লিয়ার শক্তি কমিশনের প্রধান। সে-আলোচনায় জার্মানির অ্যাটম বোমা পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন তিনি। তাই অনায়াসে নাজি-জার্মান গোষ্ঠীর কু-নজরে পড়েন। গ্রেট ব্রিটেনে পৌঁছনোর পর তিনি আমেরিকা ভ্রমণ করেন এবং ঘুরে দেখেন আমেরিকার 'ম্যানহাটন' প্রোজেক্ট। কিন্তু অ্যাটম বোমা বানানোর এমন মিশনে সংযুক্ত হতে অপারগ তিনি। তাই সসম্মানে পরিত্যাগ করেন এমন প্রস্তাব। ফিরে আসেন ইউরোপে।
তিনি আর কেউ নন, পরমাণু মডেলের একজন সফল রূপকার নোবেলজয়ী শ্রদ্ধেয় নীলস বোর। জন্ম ১৮৮৫ সালের আজকের দিনে। অর্থাৎ ৭-ই অক্টোবর। ডেনমার্কের রাজধানী শহর কোপেনহেগেনে। তিনি বিখ্যাত হন 'বোর পরমাণু মডেল'-এর জন্য। তাঁর আবিষ্কার গুরু আর্নেস্ট রাদারফোর্ড-এর পূর্বতন 'রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল' ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করে।
মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ হল পরমাণু। এ হেন পরমাণুর দুটি অংশ―
(১) পরমাণুর কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস
(২) নিউক্লিয়াসের চারপাশে বৃত্তাকার বা
উপবৃত্তাকার অসংখ্য কক্ষপথ
কেন্দ্রকের বাইরে বিভিন্ন কক্ষে এক বা একাধিক ঋণাত্মক তড়িৎবাহী কণা ইলেকট্রন থাকে। এ হেন কক্ষের আকার কেমন, তার ব্যাসার্ধ কত, নির্দিষ্ট কক্ষে ইলেকট্রনের ভরবেগ-শক্তি কত ইত্যাদি সমস্যাগুলির প্রথম আপাত সঠিক দিশা দেখায় বোর-এর পরমাণু মডেল। সেটা ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। পরমাণু মডেলের স্বীকার্য সমূহে তিনি সুচারু ভাবে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। যদিও বা এর কিছু অংশ পরে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখনও এই মডেলের চারটি স্বীকার্যের সাহায্যে দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠক্রমে পরমাণুর ইলেকট্রনের ক্ষমতা নির্নয় করে পড়ুয়ারা।
এ হেন পরমাণুর গঠন এবং তা থেকে শক্তির বিকিরণ আবিষ্কারের স্বীকৃতি স্বরূপ এই মহান বিজ্ঞানীকে এককভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯২২ সালে।
পরম শ্রদ্ধেয় নীলস বোর-এর কর্মকাণ্ডের পরিধি কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং পরে পারমাণবিক বোমা নামক মারণাস্ত্রের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে
সচেতন করতে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। দেশ-কালের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর বিশ্ব-মানবতার জয়গান ও বিশ্ব-শান্তির প্রয়াস তাঁকে সর্বকালের সেরার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
এ হেন মহান বিজ্ঞানীর আজ শুভ জন্মদিন। জন্মদিনে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও প্রণাম জানাই।
শুভ জন্মদিন প্রিয় নীলস বোর। আপনার জন্যই বেঁচে থাকুক বিশ্বমানবতা, বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক ভাতৃত্বের অটুট বন্ধন, শান্তির অমোঘ বার্তা।
0 Comments